উম্মুল মুমিনিনঃ ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন
মানুষের মধ্যে থেকে দুটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা দূর করা প্রয়োজন। প্রথমত, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা যে নবিজি (সা.) কখনো কাউকে তালাক দেননি বা ‘খোলা’ করেননি। নবিজি আক্ষরিকভাবেই কয়েকজন স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। এমনকী হাফসা (রা.)-এর ন্যায় কয়েকজনকে রাসূল (সা.) তালাক দিয়ে তা আবার ফিরিয়ে নেন। সুতরাং এ কথা একেবারেই ভিত্তিহীন, নবিজি (সা.) কখনো তালাক দেননি বা খোলা করেননি। তিনি তা করেছেন যখন প্রয়োজন হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, আমরা এ সকল ঘটনাবলি আলোচনা করতে গিয়ে যদি কারও মনে রাসূল (সা.)-এর বিবাহ বা বিবাহের অভিপ্রায় সম্পর্কে অবাস্তব ও ভুল ধারণা জন্মে, তবে তা নিন্দনীয়। আমরা এ সকল ভুল ধারণা শুধরে নিতে চাই। অসংখ্য সিরাতবিশারদ তাঁদের সিরাত গ্রন্থে উম্মুল মুমিনিনদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। সেখানে শুনতে বেমানান এমন সব বিষয় তাঁরা বাদ দিয়ে সংবেদনশীল, আবেগনির্ভর ও আংশিক বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা তাঁদের পদ্ধতি অবলম্বন করব না। সত্য গোপন রাখার চেয়ে প্রকাশ করা উত্তম। কারণ, তা পরবর্তী সময়ে আপনাদের সংশয় এবং অনির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্রের মোকাবিলায় সাহায্য করবে।
গত সাত বছরে সিরাতের এ যাত্রায় এবং নয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত বিভিন্নজনের অভিমত বলে যে আমাদের বিশদ বর্ণনার এ পন্থা গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয়। আমরা সে সময়ে বাস করছি, যখন সত্য গোপন থাকার কথা না। ১০০ বছর আগেও এসব ধামাচাঁপা দিয়ে রাখলে কাজে আসত। তাই পূর্ববর্তী বর্ণনাগুলো এমন সংক্ষিপ্ত ও সংবেদনশীল, যা শুনে আমরা অভ্যস্ত। বাস্তবতা হয়তো আমাদের মননের সাথে মিলবে না, কেননা তা তিক্ত। কিন্তু যদি আমাদের গ্রহণ করার মনোভাব ঠিক থাকে, তাহলে কোনো ঘটনাই অদ্ভুত শোনাবে না। মনে গলদ থাকলে সবই অদ্ভুত শোনাবে!
কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে-‘সিরাতের কোন অংশটি কঠিন বাস্তবতার?’ আমি বলব- জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর ঘটনাটি সবচেয়ে কঠিন। অতি আবেগীয় মানুষ উৎসগ্রন্থ বাদ দিয়ে এ ঘটনায় আপনাকে দুষবে, যখন আপনি সত্য উপস্থাপন করতে যাবেন।
আরেকটি কঠিন বাস্তবতা হলো, মারিয়া আল কিবতিয়া (রা.)-এর ঘটনা। একজন সাধারণ মুসলিম যে কখনো সিরাত অধ্যয়ন করেনি, তাকে আপনি এ ঘটনা কীভাবে বোঝাবেন- তা নিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমান সময়ে আমাদের বোনেরা এগুলো বোঝেন না; তারা বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখেন। সত্যিই আমাদের এসব ভুল ধারণা শুধরে নেওয়া প্রয়োজন, যা ক্ষেত্রবিশেষে নারী-পুরুষের ঈমান, তাকওয়া ও ধর্মচর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আবেগ, প্রণয় ও যৌন আবেদন মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের পাঠকদের কারও শুনতে সমস্যা হওয়ার কথা না যে নবিজি (সা.) খোঁড়া কাউকে ভালোবেসেছিলেন। বর্তমান সময়ে ‘নিরামিষাশি তত্ত্ব’ ব্যাপক বিস্তৃতি পাচ্ছে। তাদের ক্ষেত্রে এটা সত্য হলেও হতে পারে। আমরা জানি যে নবিজি (সা.) সত্যিই স্ত্রীদের মুহাব্বত করেছেন। যতই বিলাসিতার সুযোগ থাকুক না কেন, মানুষ তো কাঁদামাটির গড়া। আপনার কাছে বিকল্প থাকলে আপনি অবশ্যই পছন্দ অনুযায়ী নির্বাচন করবেন-এটাই তো স্বাভাবিক। ধর্মপরায়ণ হলে ইচ্ছা প্রকাশে ফেরেশতা হতে হবে, এর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা আমরা জানি, রানি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং তিনিও (মানবীয় স্বভাববশত) তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আল্লাহকে ভয় করেছেন। (সূরা ইউসুফ : ৩৪) স্বভাবজাত, বৈধ অভিলাষ থাকা ধর্মচর্চার পরিপন্থি নয়; যতক্ষণ পর্যন্ত না তা বাস্তবায়ন করা হয়। কেউ ধার্মিক হলে বৈধ অভিলাষ থাকতে পারবে না এটা অদ্ভুত ধারণা। তবে কোথা থেকে এ ধারণার উৎপত্তি, তা দারুণ এক উপাখ্যান।
আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, মানুষের স্বভাবজাত যৌন অভিলাষে ধর্মানুরাগ ও ধর্মচর্চার কোনো হাত নেই। আমাদের বুঝতে হবে, নবিজি (সা.) যেমন ভালো খাবার পছন্দ করতেন, তেমনি কোনো নারীর প্রতি তাঁর বিবাহের অনুরাগ থাকলেও তা প্রকাশ করতেন- এটা দোষের কিছু না। পারফেকশন বা উৎকর্ষতা হলো তিনি সর্বদা নিজের অভিলাষ নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং লিপ্সার বশবর্তী হননি।
অনেক বোন যেমনটা মনে করেন, রাসূল (সা.)-এর কোনো অভিলাষ ছিল না। এ ধারণা ভুল। সাধারণ জ্ঞান বলে, কাঁদামাটির গড়া মানুষ হিসেবে তাঁর আভিলাষ ছিল। মানুষ যেমন ভালো খাবার পছন্দ করে, ঠিক তেমনি মানুষ হিসেবে তিনি ভালো সম্বন্ধও কামনা করেছেন। তিনি তাঁদের কাছে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, যাদের তিনি পছন্দ করেছেন। কোনো নারীকে একজন পুরুষের পছন্দ হতেই পারে, বিবাহের জন্য তাকে প্রস্তাব দেওয়া যেতেই পারে-যেহেতু তা হালাল। নবিজি (সা.)-এর কাছে কোনো নারীকে ভালো মনে হলে তিনি তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিতেন-এতে যদি কারও সমস্যা মনে হয়, তাহলে নিশ্চয় তার অন্তরে জটিলতা রয়েছে। আমি এসব স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যেতে পারি না। যদি তা করি, তাহলে পরবর্তী সময়ে আপনারা সত্য জানলেও নিজেকে সংশয়ের মধ্যে আবিষ্কার করবেন। কারণ, পূর্বে কেউ এসব স্পষ্ট করে খুলে বলেনি।
একজন কাঁদামাটির মানুষ; যিনি সবকিছুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সেসব থেকে বিরত রেখেছেন, এসব নবিজি (সা.)-কে আরও শ্রদ্ধেয় করে তোলে। কাউকে পছন্দ হলে তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে অধিকাংশ সম্মত হয়েছে, আবার কেউ কেউ নাকচ করেছে। তাতে কী আসে যায়! কিছুই নৎ
শেষকথা হলো, আমাদের মায়েরা এটা আমাদের চেয়ে ভালোই বুঝতে পারতেন। এখনকার আধুনিক মহিলাদের চেয়ে তাঁরা নবিজি (সা.)-কে বেশি ভালো জানতেন। বিখ্যাত ঘটনা হলো, মা জুয়াইরিয়াহ (রা.) ছিলেন বনু হিলাল গোত্রের এক সর্দারের কন্যা। সবাই তাঁকে চিনত এবং গোত্রের মধ্যে তাঁর ভালো প্রভাব ছিল। আয়িশা (রা.)-এর ভাষ্যে-তিনি ছিলেন সুন্দরী তরুণী। এক যুদ্ধের সময় তাঁর গোত্রের মানুষ প্রতিপক্ষের কাছে অত্যাচারিত হচ্ছিল এবং গণমানুষ মা জুয়াইরিয়াহ (রা.)-এর সাহায্য কামনা করেছিল। অত্যাচারিতদের ছেড়ে দিতে যখন তিনি নবিজি (সা.)-এর কাছে সুপারিশ করার মনস্থির করলেন, আয়িশা (রা.) তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন-‘জুয়াইরিয়াহকে যেমন দেখেছি এবং তাঁর ব্যাপারে যত দূর জানি, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁকে দেখে প্রস্তাব দিতে পারেন।’ বাস্তবে তা-ই হয়েছিল। এটা কি অসম্মানজনক কিছু? এটা কি আয়িশা (রা.)-এর জন্য অবমাননাকর?
কোনোভাবেই না; বরং এটা কতক নারী ও কতক তরুণের জন্য অসম্মানজনক, যারা নবিজি (সা.)-কে মহানুভব মানতে চায় না। আমরা তো এতে কোনো সমস্যা দেখি না। সাধারণভাবে এটা বুঝে আসার কথা, একজন তরুণীর নেতৃত্বের গুণ আছে, গোত্রপ্রধানের কন্যা এবং অবিবাহিত-নবিজি (সা.)-কেন তাঁকে বিবাহ করতে চাইবেন না? আর তাতে তাঁর গোত্রের বন্দিরাও মুক্ত হয়ে যাবে। এখন কেউ যদি এ ঘটনাকে সংবেদনশীল রাখতে গিয়ে বলে-নবিজি (সা.)-এর মধ্যে তাঁর প্রতি কোনো অনুরাগ ছিল না; কেবল তাঁর গোত্রীয় বন্দিদের মুক্ত করতে এমন করেছেন, তাহলে সমস্যা তৈরি হয়। প্রথমত, বুখারি ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বর্ণিত আয়িশা (রা.)-এর বক্তব্যকে ছোটো করা হবে। দ্বিতীয়ত, ইতঃপূর্বে অন্য গোত্রের যুদ্ধবন্দিদের মুক্ত করতে তো এমন করেননি। অসত্য কোনো কাঠামো দাঁড় করালে এতে উক্ত ব্যক্তিরই ভোগান্তি হবে। আমাদের বৈশিষ্ট্য হলো, আমরা সত্য গোপন রাখতে চাই না। কারণ, তা অবিবেচকের কাজ হবে। জৈবিক দিক থেকে চিন্তা করলে তিনি একজন সাধারণ মানুষ, আর আধ্যাত্মিক দিক থেকে চিন্তা করলে তিনি জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে-‘জগতে আমার সবচেয়ে প্রিয় হলো নারী ও সুগন্ধি।’ যারা সমস্যা খুঁজতে চায়, সমস্যা মূলত তাদের মস্তিষ্কে; হাদিসের শব্দে নয়। যেমনটা আমরা আগেও বলেছি, কোনো পুরুষ নারীর প্রতি অনুরাগী হওয়া এবং বিবাহ করতে চাওয়া ধর্মচর্চার পরিপন্থি কাজ নয়। যখন আমরা আমাদের মননকে শুধরে নেব, তখন অন্য বিষয়াবলি মানা সহজ হয়ে যাবে। তিনি আশরাফুল মাখলুকাত, কখনো ত্রুটিপূর্ণ কিছু করেননি, কখনো লিপ্সার বশবর্তী হননি। তবে তিনি কি কাউকে বিবাহ করতে অনুরাগী হননি? হ্যাঁ, হয়েছেন এবং এতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। উম্মুল মুমিনিনের কয়েকজনকে তিনি সৌন্দর্য এবং অন্যান্য গুণের দরুন প্রস্তাব দিয়েছেন, পরে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছেন। বাস্তববাদী মানসিকতা তৈরি করলে এসব ঘটনাবলি কোনো সমস্যা তৈরি করবে না।
পরিশেষে বলতে হয়, নবিজি (সা.)-এর সেই মানসিকতা (নাউজুবিল্লাহ) থাকলে খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে ২৫ বছর অবস্থান করতেন না। তাঁর জায়গা থেকে তিনি সবই করেছেন। তিনি খাদিজা (রা.)-এর নিকট বিশ্বস্ত ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে অন্য কোনো নারীকে বিবাহ করেননি; ২৫-৩০ বছরের যৌবনেও না, আবার ৪০-৫০ বছরের পৌঢ় বয়সেও না। এটা সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ যে নবিজি (সা.)-এর মূল উদ্দেশ্য তা ছিল না। তবে কেউ মানতে না চাইলে এটা তার নিজস্ব সমস্যা। জুয়াইরিয়াহ (রা.) এবং অন্য নারীদের প্রতি তাঁর অনুরাগী হওয়া নিতান্তই মানবস্বভাবজাত তৎপরতা।
[প্রকাশিতব্য বিশ্বাসীদের মাঃ উম্মুল মুমিনিনদের জীবনী থেকে আমাদের পাথেও গ্রন্থ থেকে]
There are no reviews yet.