[ আমার অসম্ভব রূপবতী নিকাবী বউ একটা টিউব লাইট]
বিয়ের চিন্তা-ভাবনার সময়ই আমি মা-বাবা আর ভাইকে বুঝিয়েছিলাম—একজন মেয়েকে পর্দার পরিবেশ করে দেওয়া আমার দায়িত্ব। বায়োডাটাতেও সে ব্যাপারে হিন্ট দিয়েছি দেখে রফিক ভাই ভীষণ খুশি। মিনিট দেড়েক প্রবল প্রশংসায় ভাসিয়ে ভাই আমাকে বাঁশ দিলেন। বললেন, ‘এক্সপেক্টেশনের জায়গায় ওটা কী লিখেছ? তোমার স্পাউসের সেন্স অব হিউমার থাকতে হবে? হ্যাঁ? এগুলা কী জিনিস! আমার তো সেন্স অব হিউমার নাই। আমি কি তোমার ঘটক হতে পারব?’
রফিক ভাইয়ের দীর্ঘ লেকচারে বুঝতে পারলাম, বায়োডাটাতে এসব লিখতে হয় না। সৌন্দর্য লিখলে তাও ঠিক আছে, সেন্স অব হিউমারের কথা লেখা যাবে না। বাড়তি যা যা চাই মনে মনে দু‘আ করতে হবে।
বাড়তি চাহিদা কেটেকুটে বায়োডাটা আবার রফিক ভাইকে দিলাম।
আমার বিয়ে হলো অসম্ভব সুন্দরী কম বয়েসী এক নিকাবী মেয়ের সাথে।
ফেইসবুকে বউ নিয়ে নানারকম আদিখ্যেতা চলে। আমারও করতে মন চায়, শো অফ হয়ে যাবে ভেবে করি না। সাজিদ ভাইয়ের ব্যাপারটা আলাদা ছিল একটু। তারটা শো অফ বা আদিখ্যেতা মনে হয়নি। তিনি কোত্থেকে যেন জ্ঞানগর্ভ সব পোস্ট শেয়ার দিয়ে বউকে মেনশন করে দেন। তার স্ত্রী যথেষ্ট স্মার্ট। যেসব পোস্ট আমারই মাথার ওপর দিয়ে যায় যায় অবস্থা। সেসব নিয়েও তিনি সুচিন্তিত মতামত দিতে পারেন। স্বামী-স্ত্রীর মন্তব্য, প্রতি মন্তব্য আর রসবোধে পরিবেশটা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
এসব দেখে আমিও ভাবতাম—আমিও একদিন এমন করব। সবকিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু বিয়ের পর আবিষ্কার করলাম—আমার অসম্ভব রূপবতী নিকাবী বউ একটা টিউব লাইট। না না টিউব লাইটও না, হ্যাজাক বাতি। জ্বলে তো জ্বলে না, টিমটিম করে শুধু।
প্রথম প্রথম খুব হাসির গল্প, ট্রল, এইসব বউকে ইনবক্স করতাম। ও হাসত। হেসে বলত, ‘মানে বুঝিনি।’ কোনো কৌতুক বলা শেষে ও জিজ্ঞেস করত, ‘তারপর কী হলো?’
জীবনটা প্রচণ্ড হতাশায় ছেয়ে গেল। রফিক ভাইকে মাঝে মাঝে শত্রু মনে হতো। বায়োডাটায় সেন্স অব হিউমার কেটেকুটেই আজ আমার এ অবস্থা। বউয়ের সাথে কোনো ব্যাপারে কথা বলার আগ্রহ পাই না আর। কম বয়েসী মেয়ে, অনেক আগ্রহ নিয়ে চাইল্ডিশ সব বিষয়ে গল্প করতে চায়। আমি হু-হা করি। মাঝে মাঝে হতাশায় একটু রূঢ় আচরণ করে ফেলি তখন কেঁদে-কেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলে। মায়া লাগে, আবার যন্ত্রণাও লাগে। আমি কমবয়েসী-ই চেয়েছিলাম; কিন্তু এ বয়েসী মেয়েরা ওর মতো ইম্যাচিওরড হয় না।
মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যেদিকে তাকাই সেদিকেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণবন্ত সব মেয়ে। সেদিন রায়হান ভাইকে দেখলাম স্ত্রীকে নিয়ে রিকশা করে কোথাও যাচ্ছেন। দু-জন বেশ গল্প করছেন, হাসাহাসি করছেন। কী অসাধারণ বোঝাপড়া! আর আমি! না বউয়ের পুতুলখেলা টাইপ গল্প হজম করতে পারি, না সে আমার কোনো কথা বুঝতে পারে।
রায়হান ভাইকে সস্ত্রীক দেখার ঘটনাটা প্রতিদিনই মাথায় ঘুরত। একদিন ভাবলাম—এভাবে আর হয় না। রফিক ভাইয়ের সাথে দেখা করে সব খুলে বলি। ভাই যা বলে, মেনে নেব। ভাইয়ের সাথে দেখা করে নিজে আর কিছু বলতে পারলাম না। ভাই-ই শুরু করলেন। বললেন, ‘শাহীন, তোমার মনে আছে, তোমাকে ধমকে-ধামকে সেন্স অব হিউমারের ভুত ছাড়িয়েছিলাম?’
পুরোনো রাগ জেগে উঠল। মনে আবার থাকবে না! হাড়ে হাড়ে মনে আছে! মুখে বললাম, ‘জি, ভাই, মনে আছে।’
‘জানো শাহীন, দু-জন মানুষ একসাথে থাকতে এতকিছু লাগে না। সেন্স অব হিউমার, রূপ, বুদ্ধিমত্তা, আহামরি জ্ঞান—এগুলো বোনাস। থাকলে আলহামদু লিল্লাহ, না থাকলেও আলহামদু লিল্লাহ। জীবন কেটে যাবে।’
ভাইকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘রায়হানের ডিভোর্স হয়ে গেছে, জানো তো?’
চমকে উঠলাম আমি। ‘রায়হান ভাইয়ের? কেন?’ পরক্ষণেই বুঝলাম কেন ডিভোর্স হয়েছে—এটা জানতে চাওয়া ঠিক না। রফিক ভাই অবশ্য নিজে থেকেই বললেন, ‘খুব মামুলি বিষয় থেকে ঝামেলা শুরু হয়েছিল। রায়হান ভাইয়ের স্ত্রী আশা করেছিলেন তার হাজবেন্ড স্টুডেন্ট অব নলেজ হবেন। বিয়ের পর আবিষ্কার করেন অমুক তমুক শাইখের মতো জ্ঞানী হওয়া তো দূরের ব্যাপার, রায়হান ভাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার থেকেও কম জানেন। এই অভিযোগ দিয়ে টানাপোড়েনের গল্প শুরু হয়। এরপর নানান ঘটনায় দু-জনই দু-জনকে আর সহ্য করতে পারছিলেন না।’
রফিক ভাই খুব রাগতস্বরে বলছিলেন, ‘আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতে ডুবে থাকলে যা হয়। মানুষ কী পেয়েছি তা না ভেবে, কী পেলাম না—সেটা ভাবতে ভাবতে অকৃতজ্ঞের মতো জীবন কাটায়। অথচ নিয়ামতের শোকর করলে আরও পেত।’
ভাইয়ের শেষের কথাগুলো ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে দিল। আসলেই নিয়ামতের শোকর করি না বলে এত হতাশা!
সেদিন ভাইকে কিছু না বলেই বাসায় ফিরে আসলাম। ভালো লাগছিল না কিছু। বাসায় এসে ল্যাপটপে ফেইসবুক খুলে বসলাম। শুরুতেই সাজিদ ভাইয়ের পোস্ট। যথারীতি সেখানে স্বামী-স্ত্রীর কমেন্ট-পালটা কমেন্ট। এসব দেখে আর ভেতরে কোনো হাহাকার অনুভব করলাম না। মনে মনে তাদের জন্য বরকতের দু‘আ করলাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। এতদিন কি তাদের প্রতি অসংখ্য বদনজরে আমিও শরীক ছিলাম?
ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবছিলাম। বউয়ের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ল। জিজ্ঞেস করছে, ‘কী করেন?’
স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই আপনমনে বললাম, ‘নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি।’
‘কীভাবে করে?’
‘মন থেকে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলতে হয়।’
‘ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে?’
‘আরে নাহ! যেখানে খুশি তাকিয়ে বলো।’
হ্যাজাক বাতিটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘আলহামদু লিল্লাহ।’
এই প্রথম, হ্যাঁ, এই প্রথমবারের মতো একদম মন থেকে হ্যাজাক বাতির জন্য আমিও বললাম, ‘আলহামদু লিল্লাহ!’
লিখেছেন : বোন আনা আমাতুল্লাহ
There are no reviews yet.