ইসলামি রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠান
ইসলামি রাষ্ট্রীয় চিন্তার ক্ষেত্রে অনৈসলামিক পরিভাষার প্রয়োগই ইসলামের রাষ্ট্রীয় বিধানের জিজ্ঞাসু পাঠকের পথে একমাত্র বিঘ্ন নয়; সম্ভবত আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতি-প্রগতির নির্দেশক হিসেবে ঐতিহাসিক পূর্ব-দৃষ্টান্তের ওপর বিপুল সংখ্যক মুসলমানের নির্ভরতা আরও বেশি বিপদজনক।
রাষ্ট্রমাত্রই তার অধিবাসীদের সুখ ও কল্যাণ বিধান করতে চাইলে তার যেসব অপরিহার্য বুনিয়াদি কর্তব্য রয়েছে তা হলো, মানুষের সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে এবং এইভাবে রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তায় অনড়তার পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অতীত ইতিহাসের দিকে এবং একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্রের রূপ ও কর্তব্য সম্পর্কে হাল আমলের কতিপয় সুপরিচিত ধারণার দিকে তাকিয়ে আমরা সহজে অনড়তার সেই উপাদানটিকে প্রত্যক্ষ করতে পারি, যা একটা সুস্থ সামাজিক বিকাশের দাবি ও প্রয়োজনগুলোর সঙ্গে স্বভাবতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়। আমি এখানে বিশেষ করে অতীত এবং বর্তমানকালে বহু মুসলমানদের মধ্যে সক্রিয় একটি ধারণার কথা উল্লেখ করছি। যে ধারণায় মনে করা হয়, ‘ইসলামি’ এই বিশেষণে বিশেষিত হতে পারে – এমন রাষ্ট্রের রূপ শুধু একটি হতে পারে অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশেদার চার খলিফার আমলে যে রূপ প্রকাশ পেয়েছে, ইসলামি রাষ্ট্রের রূপ সবদিক দিয়ে হুবহু তা-ই হতে পারে এবং সে আদর্শ থেকে সামান্য পরিবর্তন ঘটলেই রাষ্ট্রের ইসলামি চরিত্র অবশ্যই লোপ পাবে। এই ধারণার চাইতে ভ্রমাত্নক আর কিছুই হতে পারে না।
আমরা যদি আল কুরআন ও সুন্নাহর রাষ্ট্রনৈতিক নির্দেশগুলোর বস্তুনিষ্ঠ বিচার করি, তা হলে দেখতে পাব, এগুলো রাষ্ট্রের কোন বিশেষ রূপ লিপিবদ্ধ করে না। অর্থাৎ ইসলামি রাষ্ট কোন বিশেষ আদর্শ মেনে চলবে, শরিয়া তার কোনো বিস্তারিত ছক দেয় না কিংবা সংবিধানের কোনো বিশদ তত্ত্ব এতে মেলে না। তা সত্ত্বেও আল কুরআন এবং সুন্নাহর পাঠ থেকে যে রাষ্ট্রনৈতিক বিধান উদ্ভূত হয়, তা মায়া নয়, এ কারণে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বাস্তব যে, এতে আমরা রাষ্ট্রনৈতিক পরিকল্পনার এমন একটা রুপরেখা পাই- সর্বকালে এবং মানব জীবনের সর্বাবস্থায় যার রুপায়ণ সম্ভব। কিন্তু যেহেতু উদ্দেশ্যেই ছিল যে, এই বিধান সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় কার্যকর হবে, এ কারণে এ পরিকল্পনার শুধু রুপরেখা দেওয়া হয়েছে, খুঁটিনাটি দেওয়া হয়নি। মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনসমূহ সময়-নির্ভর এবং সে কারণে অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। অনড় অনমনীয়ভাবে স্থিরীকৃত আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পরিবর্তনের এই স্বাভাবিক প্রবণতার প্রতি সুবিচার করা বোধ হয় সম্ভব নয় এবং সে কারণে শরিয়া এ অসম্ভবের চেষ্টা করে না। এটা ঐশী বিধান বলেই, এবং ন্যায়সংগতভাবেই ঐতিহাসিক বিবর্তনের সত্যটিকে আগাম বিবেচনা করে এবং বিশ্ববাসীকে অতিশয় সীমাবদ্ধসংখ্যক প্রশস্ত রাজনৈতিক মূলনীতি ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে বাধ্য করে না। এগুলো ছাড়া শরিয়া শাসন-সংবিধান তৈরি, সরকার পরিচালনা পদ্ধতি এবং দৈনন্দিন আইন প্রণয়নের একটা বিশাল ক্ষেত্রকে ইজতিহাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।
আমাদের সামনে যে সমস্যা রয়েছে, তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আমরা নিরাপদে বলতে পারি যে, ইসলামী রাষ্ট্রের শুধু একটা নয়, বহু রূপে হতে পারে এবং প্রত্যেক যুগের মুসলিমেরই দায়িত্ব হচ্ছে তাদের যুগের উপযোগী রূপটি আবিষ্কার করা। অবশ্য তার একটি শর্ত আছে; সে শর্তটি এই যে, তারা যে রূপ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ বেছে নেবে সেগুলো সামাজিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত শরিয়ার সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থবোধকতামুক্ত বিধানসমূহের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া চাই।
শরিয়ার রাষ্ট্রনীতিমূলক এসব আইনের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল খুলাফায়ে রাশেদার প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতিসমূহের মধ্যে এবং এই কারণেই তাদের রাষ্ট্র সকল অর্থেই ছিল ইসলামী রাষ্ট্র। অবশ্য আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না যে, সেকালের ইসলামী সাধারণতন্ত্র যে লিখিত সংবিধান অনুসরণ করেছে, তাতে রাষ্ট্র-পরিচালনা সম্পর্কিত শরিয়ার সুস্পষ্ট বিধানের পাশাপাশি আরও কতকগুলো বিধান ছিল, যা তখনকার দিনের শাসকবর্গ কুরআন ও সুন্নাহর মর্মার্থের নিজস্ব ব্যাখ্যানুযায়ী অর্থাৎ তাদের ইজতিহাদ মারফত প্রণয়ন করেছিলেন।
এ ছাড়া খুলাফায়ে রাশেদার আমলে আমরা এমন বহুসংখ্যক প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নমুলক বিধানের সম্মুখীন হই,যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আল কুরআন অথবা সুন্নাহ থেকে লব্ধ নয় ; বরং সরকার পরিচালনার দক্ষতা, যোগ্যতা ও জনস্বার্থের প্রয়োজনে সম্পূর্ণরূপে কান্ডজ্ঞানের ওপর নির্ভর করেই এসব প্রণীত হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ওমর ফারুক (রা) কর্তৃক পারস্যের আদর্শে কোষাগার বা দেওয়ান প্রতিষ্ঠার কথা কিংবা সদ্যবিজিত অঞ্চলসমূহে আরবীয় যোদ্ধাদের সম্পত্তি ক্রয় বা অর্জন নিষিদ্ধ করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেহেতু এসব বিধান তখনকার দিনের বৈধ সরকার কর্তৃক জারি হয়েছে, অধিকন্তু এগুলো শরিয়ার বিধানের গূঢ়ার্থের অথবা বাহ্যার্থেরও বিরোধী ছিল না, সে কারণে সে সময়ের জন্য সেগুলো আইন হিসেবে পরিপূর্ণরূপে বৈধই ছিল। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, এগুলো সর্বকালের জন্যই বৈধ বা আবশ্যিক থাকবে।
There are no reviews yet.